মুক্তিযদ্ধে হরিমোহন ছাত্রদের ভূমিকা
Mar 12, 2020   /   hmpcs.org

লেখক: আব্দুল মান্নান সেনটু
চেয়ারম্যান, নবাবগঞ্জ পৌরসভা।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা


সারা দেশের সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের মত আমাদের এই স্কুলের ছাত্রদেরও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন ও আত্মোৎসর্গের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। ২৫ শে মার্চের ভয়াল কালো রাতের পাক হানাদারদের আক্রমণের অন্তত দুই মাস আগে পরিস্থিতি সম্পর্কে আশংকা করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম নবী সাটু।

রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সম্পন্ন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সাটু শহরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রদের নিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছিল। বাঁক-খাওয়া মহানন্দা নদীর শহরের ঠিক অপর প্রান্তে দরগাস্থলের জংগলে এবং রাতে নদীর চরে এই অনুশীলন চলতো। বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং এবং রাজনৈতিক ক্লাশ চলতো। সেখানে আমি, রোজিউর রহমান বিশু, শরিফুল ইসলাম ইবু, সাদি চৌধুরী, লোকমান হোসেন মানিক, মইনুল হক চন্দন, সিরাজুল ইসলাম বুলু, মনিম-উ-দ্দৌলা চৌধুরী, মইনদ্দীন মন্ডল, শেখ হাফিজ, চন্দ্রিকা ঠাকুর সহ অনেকেই যথানিয়মে ট্রেনিং ও রাজনৈতিক ক্লাশে অংশ গ্রহণ করি।

সাটু যা ভেবেছিলো যা বলেছিলো সেটিই ঘটলো ২৫ শে মার্চের কালো রাতে মানসিক প্রস্তুতিতো ছিলোই এখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার সর্বাত্মক ব্যবস্থা চললো, হানাদারদের প্রতিরোধে ব্যারিকেড গঠন করা হলো শহরের বিভিন্ন স্থানে। তৎকালীন ই,পি,আর,পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, বীর জোয়ানদের সাথে একত্মতা ঘোষনা করে নগরবাড়ীর দিকে অগ্রসর হয়ে ঐ এলাকায় আমরা ডিফেন্স গড়ে তুলি।

তারিখটা এই মুহুর্তে মনে নেই। মহারাজপুরের কামাল ভাই, রাজশাহী রেডিও ষ্টেশনে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তার ক’দিন পরেই নবাবগঞ্জে মুক্তি যুদ্ধ পরিচালনায় কোন সামরিক অফিসার না থাকায় গেলাম আরিফ টিপু ও ডাঃ মেসবাহুল হক (বাচ্চু) এর নিকট পত্র নিয়ে নওগাঁর তৎকালীন ই.পি.আর ক্যাম্পে আমাকে পাঠানো হয়। একটি মোটর সাইকেলের আরোহী হয়ে মীর শওকত (বর্তমান পৌরসভায় কর্মরত) কে সাথে নিয়ে আমনুরা, নাচোল, পার্বতীপুর হয়ে নওগাঁ অভিমুখে যাত্রা করি। পথিমধ্যে বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কাঁচা রাস্তা দিয়ে লক্ষস্থলে যেতে ব্যর্থ হই। বৃহস্পতিবার বিমান আক্রমণ হয় নবাবগঞ্জে। সন্ত্রস্ত নবাবগঞ্জ বাসী শহর ছেড়ে বিভিন্ন দিকে আত্মরক্ষা করে। শ্মশ্মনসম নবাবগঞ্জ শহরে কুকুরের কান্না ধ্বনি ছাড়া সেদিন ফিরে এসে কিছু চোখে পড়েনি। মইশাল বাড়ীতে আটককৃত জেলা প্রশাসক ও কালেকটরেটের নাজীরকে মুক্তি দিয়ে পাশর্^বর্তী রাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। সোমবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও বজ্রের আওয়াজের সাথে প্রাতঃকালে রাজশাহী মহাসড়ক ধরে নবাবগঞ্জ শহর দখলে নিয়ে আসে পাক হানাদাররা। বিভিন্ন দিকে ছত্রভংগ হয়ে আমরা মিলিত হই মালদহ শহরে। সেখানে ভূতদা, ডাঃ মেসবাহুল হক, দিনাজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল হান্নান সাহেব সহ সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন (বর্তমান এম.পি), মন্টু ডাক্তার, শাহজাহান মিঞা (বর্তমান হুইপ), খালেদ মিয়া, হেনা উকিল সহ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের ৭নং সেকটরের মুক্তি যুদ্ধকে সংগঠিত করেন।

আমি, আঃ হাই (শহীদ), রুমি, ইবু (মরহুম), চন্দ্রিকাঠাকুর, শেখ হাফিজ সহ হরিমোহনের বেশ কিছু ছাত্র সমম্বয়ে মালদহ এর এনায়েতপুর মুক্তি যুদ্ধ ট্রানজিট কাম্পে যোগদান করি। সেখানে রাজশাহীর হাকিম সহ শিবগঞ্জের ফারুক ভাই এর সাক্ষাৎ পাই। সেখান থেকে সোনামসজিদের ঐ পারে গৌড়বাগান ট্র্যানজিট ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে আসে এবং ইনষ্ট্রাকটর হিসাবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করি। ক্যাম্প-চীফ ছিলেন আর,সি,পানুয়ার, মইনুদ্দীন মন্ডল ছিলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা, রাজশাহীর নূরুল ইসলাম ষ্টোর কীপার, ইবু ভাই ছিলেন ডেমোনেষ্ট্রেটর, চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ মান্নান ও ডাঃ মিজানুর রহমান। ওস্তাদ ছিলেন আঃ লতিফ (হাবিলদার) ও বরিশালের নায়েক সুবেদার সেকেন্দার। অধ্যাপক সাহাবুদ্দিন এই ক্যাম্পেই ছিলেন। সেখান থেকে ইবু ভাই একদিন রাতে প্রায় ২০০-২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গোপনে ভারতের দেরাদুন চলে যান মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং নিতে যারা মুলত রাজনীতি সচেতন কর্মী ছিলেন। গৌড়বাগান ক্যাম্পে হঠাৎ একদিন শহীদ জহির রায়হান নিজ হাতে ক্যামেরা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ডকুমেন্টরী ছবির জন্য সেখানে আসেন। পার্শ্ববর্তী রাম কেলীতে বাংলাদেশ থেকে আগত দুর্দশাগ্রস্ত শরনার্থীদের ক্যামেরা বন্দী করেন। সেখানেই তাঁর সাথে আমাদের শেষ দেখা।

গৌড়বাগান থেকে ভারতের শিলিগুড়ি জেলার জলপাইগুড়ি সাব ডিভিশনের পানিঘাটা থানার নক্সাল বাড়ীর গভীর জংগলে আমাদের এক মাসের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া হয়। এল, এম,জি; এস, এল,আর; থ্রি নট থ্রি রাইফেল; ষ্টেনগান, গ্রেনেড, হাই এক্সপ্লসিভের ট্রেনিং দেয়া হয়। ট্রেনিং শেষে এফ, এফ, (ফ্রীডম ফাইটার) নাম্বার দিয়ে একদিনের জন্য ৮ হাজার ফিট উপরে পাহাড়ের শহর কার্সিয়াং ঘুরিয়ে আবার আমাদের মোহদীপুরে নিয়ে আসে। সেখান থেকে শুরু হয় আমাদের প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংগ্রাম। তীব্র লড়াই চলে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ধোবড়া, বলাবাড়ী, আলী নগর, মকরমপুর,মুশরীভূজা, ইসলামপুর, বোয়ালিয়া, বাঙ্গাবড়ী, কালুপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে। নেতৃত্ব দেন ৭নং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল নুরুজ্জামান, ২য় কমান্ডে ছিলেন বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহীউদ্দিন জাহাংগীর।

মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক ঘটনা এবং এতে হরিমোহনের ছাত্রদের বীরত্ব পূর্ণ অংশগ্রহন বিষয়ে এত অল্প পরিসরে কিছু লেখা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার ২দিন আগে ১৪ই ডিসেম্বর বীরত্বপূর্ণ আক্রমনে রেহাইচরে এসে মহানন্দা ব্রীজের ঠিক ডানপাশের্^ (নবাবগঞ্জ শহর প্রান্তে) মসজিদের কাছে একটি বাংকারে গুলিবিদ্ধ হয়ে বেলা ১.০০ টা নাগাদ শাহাদাত বরণ করেন বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাংগীর। যাঁর পবিত্র মরদেহ ঐতিহাসিক সোনামসজিদে শায়িত আছেন, মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন শিলিগুড়ি রাস্তায় সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হক টুলুর কবরের পাশে।

এ ছাড়াও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন করা হয় বালিয়া দীঘির পাশে গন কবরে। এদের কারণেই নবাবগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গৌরবে গৌরবাম্বিত। স্মৃতির পাতায় এ মুহুর্তে যাঁদের নাম মনে পড়ছে তাঁদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাঁদের পদাচারণায় হরিমোহন বিদ্যালয় মুখরিত থাকতো তাঁরা হলেন— গোলাম নবী সাটু (শহীদ,যাঁর লাশ এখনো পাওয়া যায়নি), সিরাজুল ইসলাম বুলু (মরহুম), মোঃ আলী কামাল, লোকমান হোসেন মানিক, মইনদ্দীন মন্ডল , রেজাউল করিম, শেখ হাফিজ, রোজিউর রহমান বিশু, সাদি চৌধুরী, শাহরুম চৌধুরী রুমি, শরিফুল ইসলাম ইবু (মরহুম), চন্দ্রিকা নাথ ঠাকুর, মইনুল হক চন্দন, বড় ইন্দারার টোকন (স্মৃতি ভ্রষ্ট), মইনুল হাবিব সহ আরো অনেকে। সময় না পাওয়ায় এবং পত্রিকায় জায়গা সংকুলান না থাকায় শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির একটু ঝলক দিয়েই এই খাপছাড়া ইতিহাসের স্মৃতিচারণের সমাপ্তি টানছি।