খুঁজে ফিরি
Mar 12, 2020   /   hmpcs.org

লেখক: মোঃ এনামুল হক তুফান
শাখা প্রধান, করনিরূপন শাখা, নবাবগঞ্জ পৌরসভা।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা


অতীত হারিয়ে যাওয়া, পালিয়ে যাওয়া একটি ক্ষণ, একট মুহুর্ত। কিন্তু এই অতীত কখনও ছবি হয়ে, স্মৃতি হয়ে মনের দুয়ারে উকি দেয়, হাতছানি দেয় পুরোনো দিনে পুরোনো ক্ষণে বিভোর হতে। কখনও মনের অজান্তে হেসে ফেলি,আবার কখন ও লোনা জলে সাঁতার কটি। তবুও আমরা অতীতকে নিয়েই আগামী দিনেই স্বপ্নে বিভোর থাকি। যে আনন্দ আর উৎসবের মাধ্যমে আমরা হরিমোহন স্কুলের হারানো একশত বছরের অতীত কে টেনে নিয়ে আসছি, উদ্ভাসিত করছি বর্তমান প্রজন্মের কাছে।

১৯৬৮ সন আমি তখন ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। বিজ্ঞানের ক্লাশ শুরু হবে। এমন সময় শ্রেণী সাথীদের মাঝে আনন্দ উল্লাসের টেড বয়ে গেল। বিজ্ঞান স্যার নাকি বলেছেন আজ বিজ্ঞানের ক্লাশ হবে কঙ্কাল বিল্ডিং এ। দেরীতে হলেও আমিও আনন্দ মিছিলে যোগ দিলাম। এতদিন যে ঘরটিতে প্রবেশ করতে পারিনি শুধু বারান্দায় উঁকি ঝুকি দিয়ে মনেরসাধ মিটিয়েছি। আজ বীর বেশে সেই কক্ষেই ক্লাশ করব।

এখানে উল্লেখ যে, বর্তমান বিজ্ঞান ভবনটিতে সেই সময় একটি কঙ্কাল ঝুলান থাকত। কেউ বলত হরিমোহন বাবুর কঙ্কাল এটি, আবার কেউ বলত, এ স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষকের কঙ্কাল এটি। আর ঐ কঙ্কাল টি ঐখানে থাকত বলে, ঐ বিল্ডিংটির নাম হয়েছিল, কঙ্কাল বিল্ডিং। দপ্তরী আব্দুল্লাহ ভাই বিরাট দেহের অধিকার তিনি ঘাড়ের গামছা দিয়ে তালাটি ঝাড় পোঁচ করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে, তালার মধ্যে চাবি ঢুকালেন। আমি আব্দুল্লাহ ভায়ের পাশেই সহ পাঠীদের ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলাম, প্রথমে কে ঢোকে এমনি একটি প্রতিযোগিতা যেন, সহসা খেয়াল হল, তালা খুলতে আব্দুল্লাহ ভাই বিসমিল্লাহ বল্লেন কেন? আমার মনে মনে ভয় হতে লাগল। তবে কি তিনি কঙ্কালের ভয়েই বিসমিল্লাহ্ বল্লেন যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে অনেক ভীড় ঠেলে আগে ঢেকার চেষ্টা নিয়েছিলাম। আব্দুল্লাহ ভায়ের এক বিসমিল্লাহতেই আমার সব আবেগ আর উচ্ছাস উধাও হয়ে গেল। ধীর পায়ে সবার পরে পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম একবার শুধু চোখ মেলে কঙ্কালের দিকে চাইলাম। মনে মনে হতে লাগল রাতে যদি মনে পড়ে কাকে নিয়ে ব্যথরুমে যাব।

১৯৭০ সাল স্বাধীনতা আসবেই, এমন সুবাতাস চারিদিকে বইছে। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। এস এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি পাঠ চলছে। আমাদের একটি পাঠ্য বই ছিল “পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি” বইটি বাতিলের দাবীতে সারাদেশ ব্যাপি ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। আমরাও আন্দোলনকে আন্দোলিত করি। সামনে এসে যায় টেষ্ট পরীক্ষা। আমরা পরীক্ষা বর্জন করে বইটি বাতিলের দাবীতে মিটিং মিছিল করি। অবশেষে শিক্ষকগণ আমাদের কয়েক জন ছাত্র নেতাদের বাড়ীতে গিয়ে মুরুব্বীদের সহযোগিতায় থানা পুলিশের মতো পাহারা দিয়ে পরীক্ষা হলে প্রবেশ করান। প্রশ্নপত্র আর খাতা নিয়ে সবাই চুপচাপ বসে আছে। আমি কিছু না ভেবে লিখতে লাগলাম-মিছিলে মিছিলে ঘুরে লেখা পড়া গেছি ভুলে/ পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি/বাতিল কর বলে/ পরীক্ষা কবে হবে জানা ছিলনা/ হঠাৎ হলে এসে মন বসে না….
বাকী অংশ টুকু আজ মনে করতে পারিনা। হাল্কা একটা গুঞ্জন কানে এলো, মুখ তুলে চাইলাম, দেখলাম সাথী বন্ধুদের দৃষ্টিতে অগ্নি বান। পারলে সবাই যেন আমাকে চিবিয়ে খায়। ব্যপারটা বুঝতে পারলাম। সবাই পেন ষ্টাইক করেছে।

এমন সময় প্রবেশ করলেন, হেলিকপ্টার স্যার (সহকারী প্রধান শিক্ষক জনাব মমতাজ উদ্দীন সাহেব) পাতলা শরীরের গঠন, গায়ের রং ফর্সা বয়সের ভারে মুখের চামড়া গুলো প্রায় ঝুলো ঝুলো অবস্থা, পান খেতেন খর দিয়ে ঠোঁট দুটো সব সময় লাল হয়ে থাকত। পাতলা ঠোঁট দুটার ফাঁকে সন্দর মায়াবী একটা হাসি দিতেন, প্রথম সাক্ষাতে। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। সুন্দর করে হাসতে পারলেও অন্তরে দয়া মায়া খুব একটা লক্ষ্য করা যেত না।

প্রায় আমাদের টেল লেস মাংকি, নটিবয় এসব বলে ডাকতেন। অলসতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারত না, সারা স্কুল সময় সর্বত্র তিনি ছুটা ছুটি করতেন মুহুর্তের মধ্যে। আর সেই জন্যই তাঁকে আমরা হেলিকপ্টার স্যার বলতাম।

হঠাৎ করে তাঁর প্রবেশে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। কারণ তখন পর্যন্ত সবারই খাতা সাদা কাগজ হয়ে আছে। বিশেষ করে আমার একটা বাড়তি ভয় হয়ে গেল। কারণ আমি কিছু লিখেছি যা পরীক্ষার খাতায় লিখা অপরাধ। বাঁচার তাগিদে বাথরুমের নাম করে হল থেকে পালিয়ে এলাম। পরের দিন দুই পিওন পাঠিয়ে বাড়ী থেকে আমাকে ধরে আনার মতো করে ডেকে নিয়ে আসা হল স্কুলে। প্রধান শিক্ষকের রূমে শিক্ষকদের জটলা লক্ষ্য করলাম। আমাকে স্বাগত জানালেন সহকারী প্রধান শিক্ষক সাহেব বললেন-আসুন করি নজরুল , আসুন কবি রবীন্দ্রনাথ। তারপর সেই আব্দুল্লাহ ভাইকে নির্দেশ করলেন নিয়ে এস যে কটা আছে। এক সময় নিজের ডিসকো ড্যান্সের ফাঁকে লক্ষ্য করলাম লোনা জলে গতকালের সেই খাতাটি হেড স্যারের টেবিলের উপরে অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের সময়ের শিক্ষক গণ গরু ছাগলের মতো মেরেছেন, কঠিন অন্তরের পিতার মতো, বড় ভাই এর মতো শাসন করেছেন, আবার ক্লাশে নীল ডাউন করে পড়া করিয়ে নিয়েছেন। এত সবের পরও আমরা লক্ষ্য করেছি, ব্যক্তিগত ভাবে প্রাইভেট পড়ার জন্য কখনও উৎসাাহিত করেননি কাউকে। একবার আমার এক বন্ধু রবিউল একটা অংক না বুঝতে পারায় স্যার সবাইকে ছুটি দিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে অংক বুঝিয়ে করিয়ে ছেড়েছিলেন।

এই রবিউলের কথা হয়তো কোন দিনও কোথাও লিখা হবেনা অগোচরে রয়ে যাবে সবার। আমি এতক্ষণ ধরে স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে যে হারিয়ে যাওয়া অতীত কে খুঁজছিলাম, আমার স্মৃতিরা যে স্মৃতিতে পূর্ণাঙ্গতা পাবার আশায় ব্যাকুল। সে পূর্ণাঙ্গতা আমার সহপাঠী রবিউল। দোয়েলের গানের জন্য, ভোরের লাল সূর্যের জন্য বাংলা মায়ের সবুজ শ্যামলিমার জন্য, নির্ভীক প্রাণ, করে গেছে দান, অমর অক্ষয় স্মৃতি রেখে, আমি আজো স্মৃতির পাতায় খুঁজে ফিরি সেই হাসি মুখ, বীর যোদ্ধাকে।