স্মৃতিপটে লেখা
Mar 12, 2020   /   hmpcs.org

লেখক: মোঃ আহ্সানুল ওদুদ
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা


বেঁচে থাকলে তাঁরাও আজ বলতে পারতেন, শতাব্দী-প্রাচীন এই বিদ্যালয়ে মানুষ গড়ার কারিগর ছিলাম আমরা। হরিমোহনে আমার ছাত্রজীবনের অনেক স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঝে এমন কয়েকজন শিক্ষাগুরুর ব্যবহার ব্যক্তিত্ব ও ছেলে পিটিয়ে মানুষ করার ব্রত এসব নিয়েই এ স্মৃতি-তর্পণ।

গ্রামের মাইনর স্কুল পাশ করে হরিমোহনে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হই। হেড মাস্টার ছিলেন মরহুম পেলাম উদ্দীন আহমেদ সাহেব। ক্ষীণকায় ছোট খাট মানুষ কিন্তু প্রখর ব্যক্তিত্ব। মাঝে মাঝে হুট করে ক্লাশরুমে ঢুকে এক নজরে ক্লাশের পরিবেশ দেখে নিতেন। স্কুল সময়ে ছেলেদের বাদাম খাওয়া দু-চোখে দেখতে পারতেন না স্যার। উপরের ক্লাসে ইংরেজি বা সমাজপাট বিষয়ে দু’একটি ক্লাস নিতেন। তাঁর কন্ঠস্বর ছিল সতেজ আর পড়ানোর ভঙ্গীও চমৎকার। ছাত্রদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ছিল ভয় আর শ্রদ্ধার মিশ্রণে পড়া। শৃঙ্খলাভঙ্গ বা দুষ্টুমির জন্য তিনি প্রকাশ্যে কাউকে শাস্তি দিতেন না, চেম্বারে ডেকে নিয়ে সোফার নীচে রক্ষিত একগছি বেতের সদব্যবহার করতেন। আমাদের সময়ে স্কুলভবনের পেছনে সুন্দর একটি ফুলবাগান ছিল। ড্রিল ক্লাশের সময় মাঝে মাঝে ছাত্রদের দিয়ে বাগান পরিচর্যার নির্দেশ ছিল হেড স্যারের। কাজটি কিন্তু সব ছাত্রর মনোপুত ছিলনা। একবার আমাদের ক্লাসের কিছু ছাত্র বাগান পরিচর্যার সময় সোয়ানা ছাত্রদের পরামর্শে নিডাসী দিয়ে কয়েকটি গাছের শিকড় কেটে দ্যায়, গাছ কিন্তু মাটির উপর খাড়া থাকে ঠিকই। একটু পর হেড স্যার এসে একটি মোরগটুপি গাছের মাথা ধরে সোজা করে দিতে যান, কিন্তু একী ! আস্ত গাছটি অবলীলায় উঠে এলো তাঁর হাতে। এরকম আরো কয়েকটি আর যার কোথায়। ঐ গাছের সারিতে কর্মরত সব কজনের ডাক পড়লো চেম্বারে। হায়রে! শিকড় কাটার দলে আমিও যে ছিলাম। এখন উপায়? প্রথমে কেউ অপরাধ স্বীকার করতে চায়না, সঙ্গে সঙ্গে বেত চলে সাঁই সাঁই শপাৎ। সবশেষে আমার পালা আসতেই দুপায়ের কাঁপুনি ভীষণ বেড়ে গেল। এর মধ্যেই ক্যামন করে যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,স্যার এবারের মতো মাফ করে দেন, আর কখনো এরকম করবোনা। ততোক্ষণে পিঠে এক ঘা পড়ে গেছে, তবে তীব্রতা অনেক কম। স্যার স্থির হয়ে বললেন,- যাও সত্যকথা বলার জন্য এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। সত্যকথনের বিনিময়ে দন্ড মওকুফের এই স্মৃতি কি জীবনে ভুলতে পারি ?

আমাদের সময়ে স্কুলের প্রবীণতম শিক্ষক ছিলেন মরহুম গিয়াসউদ্দীন স্যার। মনে হতো অংক আর বিজ্ঞান ছাড়া কোন কিছুতেই খেয়াল নাই স্যারের। জ্যামিতি ক্লাশে নিপুণ হাতের একটানে ব্লাক বোর্ডে এঁকে দিতেন নিটোল একটি বৃত্ত, চোখের দ্যাখায় কাঁটা কম্পাসে আঁকা বৃত্তের সঙ্গে পার্থক্য ধরা যেতনা। ক্লাশে অংক করতে দিয়ে অস্থির হয়ে পড়াতেন একটু দেরী হলে। “এতদিন কী শিখলি?” এ রকম হম্বি-তম্বিতে আরো দেরী হয়ে যেত। দ্রুত মুখে মুখে অংক কষে উত্তর বলে দিতেন স্যার। এতে ভালো ছাত্রদের সুবিধা হলেও অংকে যারা টিমে তে-তালা তারা হা-করে বসে থাকতেন। অবশ্য তাদের জন্যও ব্লাক বোর্ডে সমাধান হতো সবশেষে। কখনো কোন ছাত্রকে প্রহার বা কড়া ভাষায় তিরস্কার করেছেন এমনটি মনে পড়েনা। সদাচার আর সময়ানুবর্তিতার জীবন্ত নজির ছিলেন তিনি ছাত্রদের কাছে।

আমার হাইস্কুল জীবনের স্মৃতিপটের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে মরহুম ইয়ার মোহাম্মদ স্যার। মোটা সোটা ভারিক্ক চালের মানুষ। প্রাইভেট পড়ার সুবাদে তাঁর ব্যক্তিগত সাহচর্য পেয়েছিলাম দু’বছর। সব বিষয়ে পারদর্শী এমন কৃতি শিক্ষক এ যুগে বিরল। শুনেছি স্কুল জীবনে জলপানি পাওয়া ছাত্র ছিলেন এবং মেধার জোরে হোস্টেলে থাকা-খাওয়া ফ্রি ছিল। ছাত্র জীবনের মতো শিক্ষকতা জীবনেও রেখে গেছেন কৃতিত্বের পরিচয়। মনে পড়ে ছাত্রদের অনুরোধে ক্লাসে দু-একবার ইংরেজি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন তাঁর সহজাত গমগমে পালায়। তিনি ছাত্রদের কি মিঞা? বলে সম্বোধন করতেন, মারধোর তেমন করতেন না বললেই চলে তবে কালে ভদ্রে তাঁর হাতের ওজনসই কিল যারা একবার খেয়েছে তাদের পক্ষে বোধহয় সেটা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

মরহুম আফতাব উদ্দীন সাহেব ছিলেন স্কুলের সবচেয়ে ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক। মনে হতো সব স্যার যদি আফতাব স্যারের মতো হতেন তাহলে কি মজাই না হতো। বিকালের দিকের ক্লান্তিকর ক্লাসগুলি প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো তাঁর সাহচর্যে। সহশিক্ষা কার্যক্রমে ছাত্রদের প্রতিভাবিকাশের জন্য তাঁর চেষ্ঠার অন্ত ছিলনা।

পাজামার উপর ঘিয়ারঙের লম্বা আচকান, শনপাটের মতো সাদা মাথাভরা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, পরিচ্ছন্ন হালকা-পাতলা চেহারার শিক্ষক লুতু মিঞা (মরহুম লুৎফল হক মিঞা) সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে স্কুলে ঢুকতেন। সবাই বলতো একালের শরৎচন্দ্র। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর চেহারার মিল ছিল সন্দেহ নাই। তাঁর শাস্তিদেয়ার পদ্ধতি আমার মনে ভয়ের চেয়ে কৌতুকের উদ্রেক করতো বেশী। পড়া না পারলে স্যার তেমন কিছু করতেন না তবে ক্লাসে হৈচৈ হলে চেয়ার থেকে উঠে এসে ডাষ্টার দিয়ে হাতের মাথায় যাকে পেতেন তাকেই কয়েক ঘা বসিয়ে দিতেন।

টেবিলের কাছে বসা প্রথম বা দ্বিতীয় সারির ছেলেরাই বেশীর ভাগ তাঁর আক্রমণের শিকার হতো। এর পরেও ক্লাস শান্ত না হলে আঙ্গুল দিয়ে টার্গেট করে পিছন দিকের দু-একজনকে ডেকে নিয়ে একই ভাবে পিটুনি দেতেন। এভাবে দু-এক মিনিটে ক্লাশ ঠান্ডা করে শুরু হতো পাঠদান। এ প্রসঙ্গে আরো দু’জন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কথা উল্লেখ না করে পারলামনা। খুব যতন্ত করে ইংরেজি পড়াতেন মরহুম তোফাজুল স্যার। আর তার মারেরও একটা নিজস্ব ষ্টাইল ছিল। অপরাধীর কান ধরে টেনে নিয়ে যেয়ে পিছনের দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠুকে দিতেন, আবার কান ধরে নিয়ে এসে ব্লাক বোর্ডের সঙ্গে আরেক বার। অপরাধের গুরুত্বের সঙ্গে টানা-হ্যাঁচড়ার মাত্রা নির্ধারিত হতো। অপর জন ছিলেন অষ্টম শ্রেণীর ক্লাশ টিচার রিয়াজ উদ্দিন স্যার। আমাদের ছাত্রাবস্থায় হজ¦ করে এলে সবাই হাজীসাহেব স্যার বলতো। পড়া আদায় এবং শাস্তিদান উভয় ব্যাপারেই তিনি বেশ শক্ত ছিলেন। চড় থাপ্পড় বেত্রাঘাত এগুলি তো ছিলই তার উপর ছিল বিভিন্ন রকমের নীলডাউন। যেমন সিট বেঞ্চের উপর হাঁটু গেড়ে নীলডাউন,সহপাঠীদের দিকে মুখ করে মেঝেতে নীলডাউন এবং সবচেয়ে কষ্টকর দু’হাতে কান ধরে হাফ-নীল ডাউন। এসব শাস্তির জন্য ছাত্ররা কখনো কোন শিক্ষকের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়েছে বা বিদ্রোহী হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। বরং ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। যতদূর মনে পড়ে বছরে দুবার দীর্ঘ ছুটির আগে (রোজ ও পূজার ছুটি) ছেলেরা ক্লাশ ভিত্তিক চাঁদা তুলে রঙ্গীন কাগজ দিয়ে ক্লাশরুম সাজাতো এবং ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সবাই মিলে একসাথে মিষ্টিমুখ করা হতো। মিষ্টিমুখের পর ছাত্র শিক্ষকের প্রীতি ফুটবল খেলাও অনুষ্ঠিত হতো। একটুও ধূসর হয়নি—জীবন্ত হয়ে, বাঙ¦য় হয়ে এসব স্মৃতিচিত্র এখনো আমাকে উজ্জীবিত করে।