গল্পের বই
Mar 11, 2020   /   hmpcs.org

লেখক: গোলাম রসুল / ০০০০ ব্যাচ
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা


বার বছরের এক বালক। সবেমাত্র হরিমোহন হই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। সহ পাঠিদের দু’ একজন ছাড়া সবাই অপরিচিত। কিন্তু অপরিচয়ের ব্যবধান অতিক্রম করে পরিচিত হতে বেশি সময় লাগেনি। উঠতি বয়সের এটাই ধর্ম। ফলে ভালই কাটছিল দিন। যদিও পড়াশুনা ও বাল রেজাল্ট করার ব্যাপারে ক্লাশের সবাই প্রথম থেকেই অসম্ভব তৎপর ছিল কেবল আমি ছাড়া। তবে বই পড়তে ভাল লাগতো, বিশেষ করে গল্পের বই। নিশ্চয়ই ভাবছেন এ বয়সে গল্পের বই! হ্যাঁ, গল্পের বই। এই বই পড়ার নেশাটা এত কম বয়সে, কেমন করে কখন আমাকে পেয়ে বসেছিল তা জানিনে। তবে আমাদের পাড়ার মধুদা, হরিমোহন হাইস্কুলেরই দশম শ্রেণীর ছাত্র, ‘জ্বাল জুড়ালো’ নামে একখানি কাহিনী কাব্য লিখে খুব প্রশংসা লাভ করেছিল। সম্ভবত তার কাছ থেকেই গল্পের বই পড়ার হাতে খড়ি। একই স্কুলে পড়ি। এক সাথে স্কুল যাই। প্রায় দেখতাম তার কাছে নতুন নতুন বই। কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে একদিন বললাম, মধুদা কি বই এগুলো? বললেন “গল্পের বই। পড়বি?” প্রথম না করেছি। তারপর তার সাথে আরো ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে কখন দু একখানা করে পড়তে শুরু করেছি। সেই থেকে হাতের কাছে যা পেয়েছি পড়ে গেছি। অভিবাবকরা দেখতেন ছেলে তো রাত দিন ভালই পড়াশুনা করছে। কিন্তু কি বই! তাঁরা তো তা জানতেন না। জানতে বোধ হয় ভাল হতো, নিজেকে শোধরাবার সুযোগ পেতাম। কিন্তু সে সুযোগ আর হলো না।

ইতি মধ্যে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা হয়ে গেছে। ফলাফল যে ভাল হবে না সে তো জানা কথা। ফলাফল দেখে ক্লাশ টিচার হক সাহেব তো রেগে আগুন। ততোধিক আগুন হয়ে বললেন, এটা হরিমোহন স্কুল, তোদের মত গর্দভদের আর যা হোক এ স্কুলে ঠাঁই হবেনা। এটা ঠিক যে, পরীক্ষায় খারাপ করে কিছুটা মর্মবেদনায় পীড়িত হয়েছিলুম।

কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই সব কিছু বেমালুম ভুলে গেলুম। তবে একটা ব্যাপার কিছুতেই ভুলতে পারলেম না এবং তা হলো এখন থেকে হক সাহেব প্রায় আমাকে পড়া ধরতেন। হায়রে ভাগ্য কখনো পারতাম না। আর না পারলেই অবধারিত মার। সে কি মার! মারের চোটে বাপের নাম ভুলে যাবার যোগাড়। আমার কথায় হয়োতো অবিশ্বাসের হাসি হাসছেন। হাসতে পারেন। আপত্তি নেই। কিন্তু আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনে না। বিশ্বাস না হয় আমার মত আরো অনেক ভুক্তভোগী আছেন, বিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। উত্তর শুনে আপনারও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসবে। হ্যাঁ, যা বলছিলেম, এর পর থেকে মারটা আমার জন্য এক রকম বাঁধা বরাদ্দ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। কারণ রাত দিন গল্পের বই পড়তে পড়তে ক্লাশের পড়া শিকেয় উঠেছিল। তা- নাহলে সেদিন এমনটা ঘটতো না। রোল কল হয়ে গেছে। এমন সময় কী একটা জরুরী কাজে হেডমাস্টার সাহেব হক সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। এখনি আসছি বলে হক সাহেব বেরিয়ে যেতেই ক্লাশে হৈ-চৈ ও গল্প গুজব শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শিক্ষক বিহীন ক্লাশ রুমের অবস্থা রসিক জনের ভাষায় “নাচে গানে ভরপুর ”। আর তখনই গম্ভীর সুখে হক সাহেব ফিলে এলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। এর মধ্যে এক সেকেন্ড কেটে গেছে। হঠাৎ তিনি Tense কাকে বলে? Parts of speech কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? একধার থেকে সবাইকে ধরতে শুরু করলেন। কেউ পারলো। তবে অনেকেই পারলো না। মার খেলো পাইকারী হারে। এবার আমার পালা। স্যার একটু আগে ক্লাশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে মজাকরে গল্পের বই খুলে পড়া শুরু করেছিলাম। ফলে বইটা লুকোবার সুযোগ পাইনি। আমার কাছে এসেই স্যার থমকে দাঁড়ালেন। Tense নয়, Parts of speech নয়, জিজ্ঞেস করলেন; ওটা কি বই তোর হাতে? ভয় পেয়ে গেছি, ভীষণ ভয়। তাই ভয়েই উত্তর দিলেন গল্পের বই। দেখি ? আর যাবি কোথা। ক্লাশে লুকিয়ে লুকিয়ে দেবদাস পড়া হচ্ছে? হারামজাদা, দেখাচ্ছি তোর দেবদাসগিরি বলেই শুরু করলেন মার। কিল-চড়-থাপ্পড় কিছু বাদ দিলেন না। এভাবে কতক্ষণ মেরেছিলেন জানিনে। তবে ঘন্টা পড়ার পর তিনি ক্ষান্ত হয়েছিলেন।

এতসব ঘটনার পর মনে মনে ঠিক করলাম এ স্কুল আমাকে ছাড়তে হবে। তবু কি মনে করে পরের দিন স্কুল গেলাম। স্যার ক্লাশ শেষে স্কুল ছুটির পরে দেখা করার কথা বলে চলে গেলেন। সবাই বলাবলি করতে লাগলো আমাকে টি.সি. দেয়া হবে। এছাড়া আর কি হতে পারে? একবার ভাবলাম যাবোনা- যা হয় হবে। কিন্তু পারলেন না। ছুটির পরে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে এক সময় ধীরে ধীরে লাইব্রেরীর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। কারণ স্যার একই সাথে লাইব্রেরীর দায়িত্বও পালন করতেন। স্যার ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই। আমাকে দেখতে পেয়েই স্যার কাছে ডাকলেন। তারপর একান্ত স্নেহ ভরে বললেন, “আমারই ভুল হয়েছে। গতকালই তোর বাবার সাথে আলাপ করেছি। ছুটির দরখাস্তের সইটা তোর করা নয়। তোর বাবার স্বহস্তে লেখা ”। আমি তখনো মাটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছি। স্যার আরো এগিয়ে এলেন। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন। তারপর এক সময় বললেন; “আমি কি শুধু শুধু তোদের মারি। তোরা আমার ছাত্র হয়ে কেন আরো অনেক অনেক ভাল হতে পারিস না এই রাগে দুঃখে ও ক্ষোভে মারি। ভুল সবারই হয়। তুই, কিছু মনে করিসনা

স্যারের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে এই প্রথম চোখ তুলে তাকালেম। দেখলেন স্যারের চোখে জল। চলে আসবো সেই মুহুর্তে স্যার এখানা বই হাতে দিয়ে বললেন, তুই খুব বই পড়িস জানি। এ বইটা পড়ে দেখিস। অনেক কিছু শিখতে পারবি। দেখলাম বই খানা গল্পের বই। যাযাবরের লেখা ‘দৃষ্টিপাত’। এতোদিন স্যার আমাকে মেরেছেন কোন দিন চোখে জল আসেনি। কিন্তু আজ চোখের জল আটকে রাখতে পারলাম না। সারাপথ চোখের জল মুছতে মুছতেই ফিরে এলাম।