লেখক: মোঃ দেলসাদ আলী / ০০০০ ব্যাচ
সহযোগী অধ্যাপক (অবঃ), বাংলা বিভাগ, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা।
ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বিদ্যাপিঠ হরিমোহন ইনশটিটিউশন এর পঞ্চাশ দশকের কথা বলছি। আমি তখন শঙ্করবাটি এম,ই,স্কুল (বর্তমানে শঙ্করবাটি পোলাডাঙ্গা স্কুল) থেকে পাস করে বেরিয়েছি। ভর্তি হতে হবে হাইস্কুলে, সপ্তম শ্রেণীতে, এতদঞ্চলে তখন মাত্র দুটি হাই স্কুল। হরিমোহন আর রাজারামপুর হাই স্কুল। হরিমোহন হাই স্কুলের নাম ডাক আছে, আছে জ্ঞানী-গুনী শিক্ষক মন্ডলী , সুদৃশ্য স্কুল ভবন, পরীক্ষার ফলাফল খুব ভাল। স্বভাবিক কারণেই হরিমোহন স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট হলাম।
জানুয়ারী মাসের কোন একদিন বাবার সাথে একরাশ ভয় আর কৌতুহল নিয়ে হরিমোহন স্কুল চত্বরে উপস্থিত হলাম। সামনেই শিক্ষক মন্ডলীর কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করতেই একজন প্রবীণ শিক্ষকের প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। তিনি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ডযধঃ রং ুড়ঁৎ হধসব? উত্তর দিলাম, আবার প্রশ্ন “আমার দুটি বিড়াল আছে” —ইংরেজী কর ? আমার উত্তর দেয়া শেষ হতেই ভর্তিচ্ছু আর একজন ছাত্রের কাছে হাজির হলেন। গ্রামের ছেলে, এতবড় বিদ্বান ব্যক্তির সাথে কথা বলতে আমার যে তখন কি অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। পরে জেনেছিলাম, উনিই নামকরা ইংরেজীর শিক্ষক জনাব মোঃ আমিনুল হক (লুকা মিঞা) রাশভারী, গভীর জ্ঞানের অধিকারী, স্বল্পভাষী জনাব আমিনুল হক সাহেব আর আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর ওঠা বসা, চলা-ফেরা, কথা-বার্তার স্বাতন্ত্র্যে তিনি উজ্জ্বল রূপে দীপ্তমান। হক সাহেব রাশভারী হলে কি হবে! ক্লাশের মধ্যে তিনি আলাদা মানুষ। ছাত্রদের সাথে আচরণে তিনি ছিলেন সহজ সাধারণ। নবম,দশম শ্রেণীতে পড়াতেন ইংরেজী আর ভূগোল। ইংরেজী ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণে ও লেখনীতে তিনি যে পন্ডিত ছিলেন তা সর্বজন বিদিত। কিন্তু ভূগোল বিষয়েও তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার ঈর্ষণীয়। ক্লাশে মানচিত্র টাঙ্গিয়ে তিনি পড়াতেন। পৃথিবীর যে কোন জায়গার অবস্থান তিনি অবলীলাক্রমে লাঠির অগ্রভাগ দিয়ে দেখিয়ে দিতেন, তাঁর ক্লাশে প্রত্যক ছাত্রের কাছে মানচিত্র থাকাটা ছিল অবশ্য কর্তব্য। ছাত্রদের ডেকে ডেকে তিনি বিভিন্ন দেশের অবস্থান নির্ণয় করতে বলতেন। তাতে সুফল হয়েছিল যে বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট ধারণা সে সময়েই আমরা পেয়েছিলাম। জনাব লুকা মিঞা ক্লাশে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন খাবার নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতেন। কোন খাবারে কি পরিমাণ খাদ্যগুণ আছে সে মুখরোচক গল্প করতেন যে তাতে আমাদের জিভে পানি এসে যেত। তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব মোঃ নাইমুল হক বি,এ,বি,টি। সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তিনি এ স্কুলে শিক্ষকতা করে গেছেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনন্য। তাঁর আমলে যে সব ছেলে ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হতো তারা সবাই পাশ করতো, দৈবাৎ কোন ছাত্র ফেল করলে তিনি খুব মর্মাহত হতেন। এমন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক খুব কমই দেখা যায়। শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। শুধু তিনি নন, সেই সময়ের প্রত্যেক শিক্ষকই শিক্ষকতাকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করে নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালন করতেন। জনাব নাইমুল হক সাহেব প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেও প্রতিদিন নিয়মিত ক্লাশে পড়াতেন। নবম ও দশম শ্রেণীতে ইংরেজী পড়াতেন, আর নীচের ক্লাশে নিতেন স্বাস্থ্য আর অংক। তিনি পান খেতেন প্রচুর। সব সময় মুখে পান থাকতো। তাই পড়াবার সময় পানের রস ছিটে পড়তো আর পানের গুনে পড়ার বই রঙিন হতো। তিনি উপর ক্লাশের ইংরেজীর খাতা দেখতেন, নম্বর দিতেন মেপে মেপে। নম্বর প্রদানে তিনি অত্যন্ত কৃপন ছিলেন। তাঁর পরীক্ষিত খাতায় ২০/২৫নম্বর পেলে ফাইনালে ৪০ নম্বর পাওয়া যেত অনায়াসে। এখনতো ছেলেরা ইংরেজীতে প্রচুর নম্বর পাচ্ছে কিন্তু তখন ইংরেজীতে একজন চৌকস ছাত্রও তাঁর কাছে ৫০ নম্বর আশা করতে পারতো না। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক দিন আগে। কিন্ত এখনও তিনি আমাদের অন্তরে অম্লান।
এতদ অঞ্চলে অংকের নামাকরা জ্ঞানী শিক্ষক হিসেবে জনাব মোঃ গিয়াস উদ্দীন মিয়া বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। বহুদিন তিনি এ স্কুলে নিষ্ঠা, সততা আর নিয়মানুবর্তিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শিক্ষকতা করে গেছেন। অংক বিষয়ে তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। তাঁকে অংকের গাছ বলা হতো। পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি তাঁর কাছে ডাল ভাত। অংক কষতে গিয়ে তাঁকে কোন দিন হোঁচট খেতে দেখিনি। প্রচুর চুল দাড়িতে আচ্ছন্ন জ্ঞান-তাপস এই মানুষটিকে বিজ্ঞানী বলে মনে হতো। কম কথা বলতেন, চুপচাপ থাকতেন, অংকের সূত্র নিয়ে চিন্তা করতেন। কিছুদিন পূর্বে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর কথা মনে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নামকরা শিক্ষক জনাব মোঃ লুৎফল হক সাহেবকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। দ্বিতীয় শরৎচন্দ্র হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। হ্যাঁ, চেহারায় আর চুলের বৈশিষ্ট্যে তাঁকে শরৎচন্দ্র বলে মনে হতো। মনেও তিনি ছিলেন সাহিত্যিক। প্রচুর গম্ভীরা গান তিনি রচনা করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা বিস্ময়কর। সত্য বলতে কি, সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগের সূত্রপাত ঘটে তাঁর সান্নিধ্যেই।
হরিমোহন স্কুলের ছাত্রদের অন্যতম প্রিয় শিক্ষক জনাব মোঃ আফতাব উদ্দীন। ইতিহাস পড়াতেন। সপ্তম শ্রেণীতে ইংরেজীও পড়াতেন। গল্পের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের ঘটনাবলী প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরতেন। ফলে ইতিহাসের ক্লাশে আমরা প্রচুর আনন্দ পেতাম। তিনিও আর আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
মহানন্দা তীরবর্তী বারঘরিয়া গ্রাম থেকে আসতেন সর্বজন প্রিয় শিক্ষক শ্রী অক্ষয় কুমার পাল (লক্ষী বাবু)। গেম টিচার হিসেবে তিনি সুপরিচিত। তবে তিনি বাংলাও পড়াতেন। লক্ষীবাবুর ঐকান্তিক নিষ্ঠা, সততা আর তৎপরতায় ফুটবল মাঠে হরিমোহন হাই স্কুল সে সময় এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছিল। এই সময়ের বিখ্যাত খেলোয়াড় ধুলু ভাই (আলহাজ¦ নজরুল ইসলাম) সাইদুল ইসলাম, লক্ষন, পটল,মুসা প্রমুখের ক্রীড়া নৈপূণ্য শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।
লিখতে বসে আজ অনেক কথা মনে পড়ছে কিন্তু সব কথা লিখতে গেলে পরিধি বেড়ে যাবে। তাই আর একজনকে স্মরণ করে শেষ করবো আমার এই লেখা। যাঁর কথা বলতে যাচ্ছি, তিনি হচ্ছেন হরিমোহন স্কুলের দপ্তরী, নাম ধরনী। ধরনীদা। সকলের দাদা। ধরনী নামের সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বেঁটে-খাঁটো, নাদুস্ নুদুস্ সদা-প্রফুল্ল একটি মানুষকে। যিনি স্কুলের ঘন্টা বাজাতেন আর তামাক সেবন করতেন। ঘন্টার ধ্বনি তো আমরা প্রতিনিয়তই শুনছি কিন্তু ধরনীর বাজানো ঘন্টা ধ্বনির সুরই ছিল আলাদা। তার ঘন্টার আওয়াজ শুনলেই বহুদুর থেকে মানুষ বলে দিত, ‘ধরণীর ঘন্টা বাজছে’। আমার মনে হয়, সে সময় ধরনী ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় পিওন ছিলনা। তবে ধরনী একাই একশো। ধরণীকে ভোলা যায়না। ভোলা যায়না ধরণীর খাজার কথা। বর্তমান স্কুলের উত্তর পশ্চিম দিকে মসজিদ সংলগ্ন একটি ছোটি ঘর ছিল। সেটিই ধরণীর দপ্তর। সেখানে থাকতো তামাক সেবনের সরঞ্জাম আর চাঙ্গারীতে সাজানো ‘খাজা’ আর ‘পাক’। সেই সময়ের হরিমোহন স্কুলের এমন কোন ছাত্র নেই যে বলতে পারে, আমি ধরনীয়র খাজা খাইনি। এক আনা, কখনও কখনও দু’আনা দিয়ে টিফিন পিরিয়াডে খাজা কিনে দুপুরের জলখাবার শেষ করতাম। এখন তো স্কুল দুপুরে টিফিন এর ব্যবস্থা আছে কিন্তু তখন ধরনীর খাজা ছাড়া আর কিছু জুটতো না।
শৈশব কালে এমন গৌরবদীপ্ত বিদ্যালয়ের জ্ঞানী-গুণী শিক্ষকের সাহচর্য্যে শিক্ষা লাভের সুযোগ পেছিলাম বলে আজ নিজেকে ধন্য মনে করি। এ বিদ্যালয়ের গৌরব আরো বৃদ্ধি পাক, বর্তমান প্রজন্মের ছাত্ররা যথার্থ শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করুক এই কামনা ব্যক্ত করে শেষ করছি আমার কথা।