হরিমোহন স্কুলের ছাত্র ও চেতনা
Mar 10, 2020   /   hmpcs.org

লেখক: মোঃ হাবিবুর রহমান / ০০০০ ব্যাচ
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা


প্রাইমারী স্কুল শেষ করে ১৯৫৩ সালে নবাবগঞ্জ হরিমোহন হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। মনে পড়ে তখন ক্লাশে রোল কলের পর কেউ আসলে আর ঢুকতে দেয়া হত না। যার ফলেই আজ সময়ের কাজ সময়ে শেষ করার চেতনা পেয়েছি। লেখা পড়ার সময়ও সেই ছাত্র জীবনের সময়ানুবর্তিতার ছাপ পড়েছে। ঠিক সকালেই ফজরের নামাজ পড়েই বই হাতে নিয়ে বসা। বাড়ীতে কয়েক ঘন্টা লেখা পড়া করে মহানন্দা নদীতে গোসল করা। ঠিক সময় মত হাঁড়ি থেকে ভাত খুলে প্রয়োজনে নিজে ভর্তা বা ডিম ভেজে রান্না ঘরেই খেয়ে পায়ে হেঁটেই ঠিক ১০ টার মধ্যেই ক্লাশে যাওয়া। ক্লাশ শেষ করে বাড়ীতে এসে বিকেলে দুধ ভাত খেয়ে পুনরায় স্কুলের মাঠে ফুটবল, ভলিবল, হকি, লংজাম্প, হাই জাম্প প্রভীতি খেলে ঠিক সন্ধ্যায় ফিরে যাওয়া এবং মাগরিবের নামাজের পর পড়ার টেবিলে পড়তে বসে যাওয়া। লেখা পড়া, খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাত ১০টার মধ্যে শুয়ে পড়া। স্কুলের জীবনে ঘড়ির কাঁটার সাথে জীবনে চলার রুটিন শিখেছি।

ছাত্র জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা মুখের ভাষা, বুকের ভাষা, মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য ২১ শে ফেব্রুয়ারী সালাম,বরকতকে শহীদ হতে হয়েছে। কোন দেশে নিজের ভাষায়, কথা বলার অধিকারের জন্য রক্ত দিতে হয়েছে কিনা জানিনা। আমরা উক্ত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করি, পথসভা করি, এবং শ্লোগান দেই। ১৯৫৪ সালে দেশে ভীষণ বন্যা হয়। লোকে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করতে থাকে। দুঃস্থ ও অভাব গ্রস্থদের সাহায্যের জন্য ত্রাণ শিবির খোলা হয়। মানুষকে বাঁচাবার আশায় আমরা মানবতার সেবায় আত্ননিয়োগ করি

আরও মনে পড়ে স্পোর্টস ম্যান হিসাবে নজরুল (দুলু) ভাই, ময়নুল ভায়ের ফুটবল খেলা, দৌড়, লংজাম্প প্রভৃতি খেলায় একছত্র ভাবে জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের কথা। সে সময় ফুটবল খেলায় একই টিমের সাথে ৫/৬দিন ড্র চলে। সকাল বিকাল লোকে সে খেলা মনে প্রাণে উপভোগ করে। সে সময় অবশ্য আমি নিজে একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে জেলা পর্যায়ে ইন্টার স্কুল খেলায় কৃতিত্বের সাথে খেলাধুলা করি। তখন প্রতি বৃহস্পতিবার বিতর্ক প্রতিযোগিতা একটা রুটিন ব্যাপার ছিল। সে অনুষ্ঠানেও অংশ গ্রহণ করে হাসান আলি উক্ত বিতর্ক অনুষ্ঠানে আব্দুল্লাহ হারুন পাশা, জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ মোতাহার হোসেন, মোহিত কুমার দাঁ, আনোয়ারুল কামাল উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান, সুলতানুল ইসলাম প্রমূখ অংশগ্রহণ করেন। মাঝে মাঝে গম্ভীরা গান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। সে অনুষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক মোঃ নাইমূল হকের পরিচালনায় নানা কুতুবুল ভাই ও নাতী হিসাবে মরহুম সবুর ভাই, রকিব ভাই রোল করতেন। তাছাড়া বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একাংকিকা ‌‘ঈমান’ নাটকে আমি অংশ গ্রহণ করি।

সে সময় নবাব সিরাজ উদ্দোল্লা নাটকে নিজে ছিলাম সিরাজউদ্দোল্লার ভূমিকায় এবং মরহুম বন্ধু আব্দুল মান্নান আলেয়ার ভূমিকায় অভিনয় করে। মীরজাফর যে বিশ্বাঘাতক এবং বিশ্বাসঘাতকতা যে একটা অমানবিক অপরাধ তা সর্বস্তরে বর্জনের অনুভূতি ও অনুপ্রেরণার শিক্ষা পাই। সে সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বন্ধু হাসান মনজুর, হাদি, সেজাউর, সিরাজুল প্রমুখ বন্ধুগণ গান করে এবং অন্যান্যরা কবিতা আবৃত্তি করে।একজন খেলোয়াড় হিসাবে খেলার মাঠে নিজের চিন্তাধারা মতে ও বেশভূষায় খেলাধুলা করি। সে সময় মরহুম প্রাক্তন মহকুমা প্রশাসক জনাব আমিনুল ইসলাম চৌধুরী স্বর্গীয় গেম টিচার লক্ষীবাবুর সম্মুখে কমেন্ট করেছিলেন যে ভাল খোলায়াড় হয়ে হাবিবুর রহমান পাজামা পড়ে খেলে কেন? তিনি বলেছিলেন সে ধর্মপ্রাণ ও এটা তার স্বকীয়তার প্রমাণ। এখানে ‍উল্লেখ্য সে সময় হরিমোহন স্কুলে নামাজ পড়ার জন্য কোন মসজিদ ছিল না তাই শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছ থেকে চাঁদা উঠিয়ে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় একতা, শৃংখলা ও প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের প্রতীক স্কাউট দল ছিল না। সেটাও প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এখানে আরও উল্লেখ্য যে পরীক্ষার হলে অংক পরীক্ষার সময় উত্তর ঠিকভাবে না লিখতে পারার ফলে আমার কান,মূখ ও চোখ লাল হয়ে যায়। এ চিত্র দেখে স্বর্গীয় গেম টিচার আমাকে বাহির থেকে ঘুরে আসতে বলেন। কিন্তু সে বিষয়ে খারাপ করলেও বাইরে যাই নাই এবং কারও দেখেও লিখি নাই। এ সময় একটা ঘটনা আমার একান্ত বন্ধু নুর মোহাম্মদ ও মরহুম আব্দুল মান্নানের বয়স ১৪ বৎসর না হওয়ার জন্য মরহুম প্রধান শিক্ষক নাইমুল হক ইচ্ছা করলে তাদের বয়স বৃদ্ধি করে দিতে পারতেন। তা না করে নীতিগত ভাবে সে সময় প্রকৃত পক্ষে তাদের বয়স কত জানার জন্য মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে তাদের কে ঢাকায় প্রেরণ করেন।

এখানে সবচেয়ে আনন্দ লাগে শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক জনাব মোঃ নাইমুল হক, আমিনুল হক লুকা মিয়া, জনাব মোঃ লুৎফল হক ও জনাব গিয়াসউদ্দীন শিক্ষক মহোদয়গণের সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত থাকতে পেরে। তাদের স্মরণে শুধু মনে পড়ে জনাব নাইমুল হক পান খেতেন বেশী। তাঁর পানের রসে বই রঞ্জিত হবার ভয়ে কেউ বই-সহজে দিতে চাইতো না তবুও তাঁর পড়ার বিশ্লেষণ, পড়ানোর কায়দা ও মনে রাখার কৌশলগত বৈশিষ্টের কারণে ছাত্ররা বেশ ধীর স্থিরভাবে ক্লাশে বসে থাকতো এবং মনোযোগ সহকারে শুনতো। কোচিং ক্লাশে যাতে পরীক্ষার্থীরা সকলে আসে তাই তাঁরা সময় মত কোচিং ক্লাশে আসতেন এবং শিক্ষা দিতেন। প্রধান শিক্ষক প্রয়োজনবোধে কোন ছাত্র কোথায় যায়, কি করে তা দেখার জন্য লাঠি হাতে স্কুলের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর ভয়ে কেউ ক্লাশে ফাঁকি দিতে পারতো না বা এদিক ওদিক যেতে পারতো না।

জনাব আমিনুল হক (লুকা) মিয়ার বৃদ্ধ বয়সে ইংরেজী উচ্চারণ ছিল সাবলীল এবং সময় মত ক্লাশে এসে যে ভাবে পড়াতেন তাতে ইংরেজী বিদেশী ও শক্ত ভাষা হলেও সব ছাত্রই মনযোগ সহকারে শুনত। তাঁর পড়ানোর কৌশলের জন্য ইংরেজী কঠিন বিষয় হলেও সহজেই ছাত্রদের কাছে বোধগম্য হতো। বিশেষ করে তিনি ভূগোলে বেশ পারদর্শী ছিলেন। বোর্ডে টাংগানো মানচিত্র দেখাবার জন্য বিশেষ বিশেষ ছাত্রকে ডাকতেন এবং ছাত্রদের দ্বারা ছাত্রকে শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করতেন। সে সময়ের একটা ঘটনা মনে পড়ে স্কুল বন্ধের পূর্বে প্রতি বৎসর ক্লাশে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খাবার পর্ব থাকতো। সে অনুষ্ঠানে আমি নিজে আম, লিচু, কলা, পেপে প্রভৃতি ফলমুল দিয়ে খাবার পর্বের প্রস্তাব করলে তিনি বলেন না ‘ফারাটা-গোস্তই’ ভাল হবে। এ প্রস্তাবে আমি তার উচ্চারণের জন্য হেসে দিলে এটা লক্ষ করে তিনি সাথে সাথে এক বেত মেরে হাজিরা বহি এনে আমার ফাইন করে দেন। তিনি সাধারণতঃ ক্লাশে অনুপস্থিত থাকতেন না। এমন কি বৃষ্টি বাদল হলেও ছাতা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাত, পা, শরীর স্মার্ট রেখে সোজাসুজি ক্লাশে এসে সোজা হয়ে বসে পড়াতেন। কোন ক্লাশে ফাঁকি দেবার উপায় ছিল না।

জনাব লুৎফল হক, তাঁর সব চুলই সাদা। দেখতে অনেকটা শরৎ চন্দ্ররে মত। তিনি বাংলা পড়াতেন। ক্লাশে মনে হত শরৎ চন্দ্ররে আসর বসেছে। সে ক্লাশে সকলেই মনযোগ সহকারে শুনতেন।

জনাব গিয়াসউদ্দিন মিয়া। তিনি একজন প্রবীণ অংকের শিক্ষক। তাঁর চেহারা বৈজ্ঞানিকদের মত। তিনি অংকে খুব পারদর্শী ছিলেন তিনি অনেক সময় মুখে মুখে বলে বা বোর্ডে লিখে একনিষ্ট মনে অংক শেখাতেন।তাঁর অংক শেখানোর কলা কৌশল একে বারে বিজ্ঞান সম্মত। আমি এই পদ্ধতি পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারিনি। তাই তিনি বলেছিলেন অংকের কারণে আমার ফলাফল ভাল হবে না।

হরিমোহন স্কুলে ছাত্রবস্থায় যার অবদান সবচেয়ে বেশী সেই প্রাইভেট মাষ্টার ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যের প্রতীক রামকৃষ্ণ মিশনের সেবক শ্রী অভয়পদ মুখার্জির অবদানের কথা উল্লেখ না করে পারছিনা। তিনি একজন সৎ,ধর্মপ্রাণ, চিরকুমার, সহজ, সরল চরিত্রের মানুষ। তাঁর পরনে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, খালি পা, গলায় পইতা, একনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। তাঁর চলন বলন ছাত্র জীবনে বেশী প্রভাব বিস্তার করেছে। আমি নিজে পড়তে না চাইলেও নিজে এসে ডেকে হ্যারিকেন দেখিয়ে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতেন এবং রাস্তায় ইট বা অন্য কোন আবর্জনা থাকলে তা পা অথবা হাত দিয়ে সরিয়ে ফেলতেন। সাধারণ জ্ঞান ও ইংরেজী শিক্ষা দেওয়ার জন্য আগের দিনের দৈনিক কাগজগুলি বাড়ীতে পড়ার জন্য দিয়ে যেতেন যেন ভাল ছাত্র হিসেবে সাধারণ জ্ঞান শিখতে পারি ও দেশ-বিদেশের সমাজ ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক উত্থান পতনের খবর জানতে পারি। সবচেয়ে বেশী করে মনে পড়ে অবসর সময়ে গরীব ও দুঃস্থ মানুষের সেবা করার জন্য শ্রী রামকৃষ্ণ মিশনে “হোমিও চিকিৎসালয়ে” তাকে ডাক্তারী কাজে সহায়তা করে রিক্সাওয়ালা, কুলি, মজুর প্রভৃতি মেহনতী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি নিজের মানুষ হিসেবে কাছে বসতে পারি। আজও মানবতার কাছে আত্মনিয়োগ করে তাদের হোমিও প্যাথিক চিকিৎসা করার সাথে সাথে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নিজে ও পারিবারিক জীবনে ব্যবহার করি। তার সে অনুপ্রেরণার জন্য কম জীবনে বিভিন্ন স্থানে হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও চিকৎসালয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই। তাই আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সকল শিক্ষকের ঋণ।

হরিমোহনের এক জন ছাত্র হিসেবে অর্জিত চিন্তা, ধ্যান-ধারণ ও চেতনা কর্মজীবনে প্রস্ফুটিত করার প্রয়াস পেয়েছি। চাকুরিজীবি হিসাবে আমি শাসকের চেয়ে সেবক হিসেবে ধ্যান-ধারণা নিয়ে বাস্তব বাধা-বিপত্তি, সমস্যা প্রভৃতি সমাধান কল্পে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রীয় জীবনের আসল চিত্র তুলে ধরার প্রয়োজনের তাগিদে চাকুরীতে ঢুকি। চাকুরীতে ঢুকেই কথায় কথায় বিদ্রুপের সুরে শুনি, ‘আপনারা তো আমলা আপনাদের দৌরাত্যে বাঁচা যায় না’। তাই মনে মনে চিন্তা করি কিভাবে এ ধারণা থেকে রেহাই পাই। এ জন্য চাকুরী জীবনে নিজেকে এ অপবাদ থেকে বাঁচাবার জন্য কামলা হিসেবে কাজ করি। চেষ্টা করি নিজেকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে চিহ্ণিত করার সে কারণে প্রশাসক হিসেবে নিজেকে নিবেদিত করার ধ্যান-ধারণা ও চেতনায় অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হই।

ছাত্র জীবনের চেতনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে কর্মজীবনে বুঝতে পারছি সত্যি ছাত্র জীবনই স্বর্ণময়। বর্তমানের ছাত্র সমাজের কথা বলতে গেলে ভেসে উঠে সন্ত্রাস, আতংক, ধর্মঘট হরতাল, মিছিল প্রভৃতির কথা। এটা অবশ্য ছাত্রদের দোষ না, এটা অভাব স্বভাবের, চরিত্র গঠনের। এদেশের মানুষ অত্যন্ত গরীব ও অশিক্ষিত। তাই প্রথমে ডাল-ভাত খাবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে এবং দেশ আরো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে।