লেখক: মোঃ হাবিবুর রহমান
প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা।
নবাবগঞ্জ সদরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় শতবর্ষ অতিক্রম করে এক মহীরূহে পরিণত হয়েছে। এই বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলাম ভেবে নিজেকে আজ অত্যন্ত গৌরবাম্বিত মনে হচ্ছে। সেই সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনেক স্মৃতিময় ঘটনা আর প্রিয় কিছু মুখ। মনে পড়ছে কিছু দেবতাতুল্য শিক্ষকের কথা যাঁর শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহের জন্যই শিক্ষকতা করেননি বরং যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলার জন্য একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে গেছেন। আরও মনে পড়ছে প্রিয় বন্ধুদের কথা যাদের সামনে কৈাশোরের অনেক রসময় মুহুর্ত গুলো কেটে গেছে, আজ শুধুই স্মৃতি।
আমি ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত (ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী) হরিমোহন স্কুলে লেখা পড়া করে ৯ম শ্রেণীতে তৎকালীন পাবনা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল (বর্তমান ক্যাডেট কলেজ) এ ভর্তি হই। কিন্তু রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের নিয়মিত ও শৃংখলিত জীবন আমার মোটেই ভাল লাগেনি। সেখানে কোন কাজেই আমি মনোনিবেশ করতে পারিনি। স্বর্গীয় মার ইচ্ছায় আমি ফিরে আসি এবং ১০ম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য পুনরায় হরিমোহন স্কুলে আবেদন করি। প্রথম অবস্থায় আমার আবেদন অগ্রাহ্য হয়। এর পর আমি সরাসরি আমার পিতৃতুল্য প্রধান শিক্ষক জনাব মাহাতাব উদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করে তাঁকে বলি যে, স্যার আমাকে যদি হরিমোহন-এ ভর্তি না করেন তাহলে আর কোথাও আমার দ্বারা লেখাপড়া হবে না। উনি আমার কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ থাকলেন তারপর বলেন, “যাও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ কর এবং ভর্তি হও ” । আমি সারা জীবন স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব এই কারণে যে, আমি নিশ্চিত, সেদিন স্যার ফিরিয়ে দিলে আমার লেখা পড়ার পাঠ সেদিনেই চুকে যেত।
ছোট থেকেই দল বেঁধে ঘোরাফেরা ও আড্ডা দিয়ে বেড়াতাম তাই স্কুলে প্রথম থেকেই স্যারদের দৃষ্টিতে পড়ে যাই। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বৃন্দ স্কুলেই শুধু আমাদের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন না, সর্বদা তাঁরা ছিলেন আমাদের প্রশাসক আবার বন্ধুও বটে। এ মুহুর্তে খুব মনে পড়ছে প্রিয় শিক্ষক মরহুম আফতাব উদ্দীন সাহেবের কথা। খুব ভাল বাসতেন আমাদেরকে। তাঁর জন্য কষ্ট হয়। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে শতর্ব উদযাপন করার জন্য প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সাবেক সভাপতি হিসাবে চিন্তাভাবনা করছিলেন। অসুস্থতার কারনে সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। সান্তনা এই টুকু যে, শতবর্ষের প্রথম অনুষ্ঠানে ১লা জানুয়ারি ১৯৯৪ ইং বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রদের যে র্যালি বের হয় তাতে অনেকের সাথে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। আমি তাঁর মতো মহানুভব আদর্শ শিক্ষাগুরুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
আড্ডা দিয়ে ও দুষ্টুমি করে বেড়াতাম বলে শিক্ষক মহোদয়গন আমাকে শাসন করতেন। চলাফেরার প্রতি দৃষ্টি রাখতেন, ঠিক তেমনি প্রচন্ড ভাল বাসতেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম আবুল কাশেম, জনাব মোজাম্মেল হক, জনাব আলতাফ উদ্দীন সাহেব আমাদের যথার্থ ভাবে গড়ে উঠার জন্য বিভিন্ন ভাবে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। এই সব কথা মনে পড়ছে আর অনেক স্মৃতি ফুটে উঠছে চোখের সামনে। আমার বন্ধুদের মধ্যে মোবিন, নজরুল, মান্নান, মতিন, বাবলু, খালেক, মাহবুব, মতি ঠিক আমার মতই পড়ালেখার প্রতি যতটুকু আগ্রহী ছিল তার চেয়ে বেশী আগ্রহী ছিল আড্ডা মেরে সময় কাটাতে। আমাদের নিয়মিত আড্ডা বসত স্কুল সংলগ্ন স্কাউট ভবনের ছাদে। আমরা ভাবতাম এই জায়গার খবর হয়ত স্যারেরা পাবেন না। কিন্তু স্যারেরা আমাদের খবর ঠিকই রাখতেন। একদিনের ঘটনা বলি স্কাউট ভবনের ছাদে আমরা নিয়মিত আড্ডায় বসেছি, দুই একজন ধুমপানে রত আছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম মরহুম আবুল কাশেম, জনাব মোজাম্মেল, জনাব আলতাফ উদ্দীন আমাদের বড় ভাই বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জনাব রোজিউর রহমান বিশু ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছেন। আমরা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। তবু দেখি স্যারেরা আমাদের দেখে ফিরেনা গিয়ে উপরে উঠে আসছেন। আমরা উপায়ান্তর না দেখে ভবন সংলগ্ন আমাদের স্কুলের পিয়ন কুদ্দুস ভায়ের পানের দোকানের ছাদে লাফদি এবং রাস্তায় পড়ে দেদৌড়। পরবর্তীতে আমাদের আড্ডার স্থান হয় স্কুলের পাশের্^ অবস্থিত সাধারণ পাঠাগারের বারান্দায়। তখন সাধারণ পাঠাগারের সামনে অনেক গাছপালা ছিল বলে রাস্তা থেকে আমাদের দেখা যেতনা। সেখানে তাসের আড্ডাও বসত। একদিনের ঘটনা, আমি প্রথম সেদিন তাসখেলা শিখছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম পাঠাগারের গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছেন, জনাব আবুল কাশেম, জনাব মোজাম্মেল হক, জনাব আলতাফ উদ্দীন ও জনাব এ্যাডঃ শামসুল হক সাহেব। পাঠাগার সংলগ্ন টাউন ক্লাবের সদস্যদের অসুবিধা হত বলে এই এ্যাকশন। শিক্ষগনকে দেখে দিলাম ছুট। আধঘন্টা পর ফিরে এসে দেখি আমাদের ফেলে যাওযা তাস, সেন্ডেল, জুতা যথাস্থানেই আছে। আমার জীবনে মরহুম আবুল কাশেম স্যারের প্রভাব ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন আমার মত তাবৎ বাউন্ডেলেদের প্রাণের শিক্ষক। শুধু তার সরাসরি ছাত্রই নয় অন্য স্কুলের বাউন্ডুলেদের প্রতিও ছিল তার প্রচন্ড প্রভাব।
এসব ঘটনা বলার কারণই হচ্ছে আমাদের প্রতি শিক্ষক বৃন্দের দায়িত্ব বোধ সম্পর্কে সচেতনতার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা। স্কুলে পড়িয়েই তারা দায়িত্ব শেষ করেননি। সব সময় লক্ষ্য রাখতেন ছাত্রদের গতিবিধির উপর ভাল মন্দের উপর। আমরাও তৎপর থাকতাম স্যারদের সামনে যে কোন অবস্থাতে যেন অশোভন আচরণ না হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের সাথে বন্ধুর মত মিশতেন।
আজ এই অবিস্মরণীয় অনুষ্ঠানে স্কুল জীবনের সেই সোনালী স্মৃতি ভরা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। অনেক কথাই লিখতে ইচ্ছা করছে, সংক্ষিপ্ত পরিসরের কারণে সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।