বিস্মৃত প্রায়
Mar 11, 2020   /   hmpcs.org

লেখক: সুলতানুল ইসলাম (মনি) / ০০০০ ব্যাচ
এ্যাডভোকেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫ শতবর্ষের স্মরণীকা


এতক্ষণ গভীর ঘুমে অচেতন নবাবগঞ্জ শহরটা জেগে উঠেছে। আম্রকুঞ্জে ঘেরা শহরটা ঘন কুয়াশার চাদর পরে দাঁড়িয়ে আছে। অকট্রর মোড় থেকে একটা মাঝারি পাকা রাস্তা আমবাগানের ভেতর দিয়ে সুরম্য কোট অট্রালিকাগুলির পাশ কাটিয়ে নিউমার্কেটের উত্তর গেটের পাশ দিয়ে একটু এগুলে পূর্ব পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণ মূখী প্রাচীন আর আধুনিক স্থাপত্বের স্বাক্ষর বহন করে শহরের পশ্চিম দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে শতবর্ষ পূর্বে জন্ম গ্রহণ করা স্বর্ণগর্ভা হরিমোহন হাই স্কুল রয়েছে।

শতর্বষ ধরে জন্ম দিয়েছে-সমর সেনের মত কুটনীতিকের। দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার ডঃ জহুরুল হক, বৈজ্ঞানিক সন্তোষ ভারতশ্রী মনতোষ রায়, আব্দুল্লাহ হারুন পাশার মত ডাকসাইটে সি,এস,পি,হাবিবুর রহমানের মত সৎ এডিসোনাল কমিশনার, মোহিতের মত আদর্শ শিক্ষক এবং ধর্ম প্রাণ কর্ণেল আনোয়ার এবং সিরাজুল ইসলামের (বুলুর) মত মুক্তিযোদ্ধা। ছোট পাড়া গাঁয়ের সদৃশ ধূলিমলিন শহরের এবড়ো থেবড়ো আর ওর অস্তিত্ব নেই। গড়ে উঠেছে চমৎকার ট্রফিক আইল্যান্ড, রং বেরং এর দোকান। এ বড় ইন্দারার পানি দিয়ে বড় রাস্তার ধুলি ঝড় বন্দ করার ব্যর্থ্ প্রয়াস চালত পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌর ভবনের ঠিক দক্ষিণে ইসলামপুরে আমাদের বাড়ি।

১৯৫৪ সালের শিউলি ঝরা একটা সকাল, রোমাঞ্চ, আর গবে ভরা। সারা রাত ঘুম আসেনি, ভর্তি হব স্বপ্নের হরিমোহন হাই স্কুলে। আমি আর কালু (মোহিত কুমার দাঁ) বাড়ী থেকে স্কুলের পথে রওয়ানা হলাম ক্লাস সেভেন ভর্তি হবো। প্রথমেই দেখা কালের সাক্ষী গাব গাছটার সঙ্গে, ওর সাথে পরিচয় সেই শৈশব কাল থেকেই, ওর সাদা ফুলে দুহাতের অঞ্চলি ভরেছি, পাকা হলুদ গাবের সাধ আও ঠোঁটে লেগে আছে। কত আপন কত পরমাত্মীয় তবুও সেদিন আমার বড় নতুন মনে হলো তাকে, সঞ্চিত পায়ে ওকে ছাড়িয়ে হরিমোহনে এলাম, পাষাণ প্রাচীর নেই, নেই কোন গেট চার পাশের আম বাগানে ঘেরা তখনকার ছেলেদের আশা আকাঙ্খার প্রতীক হরিমোহন, প্রায় সকলেই হাফপ্যান্ট পরা, এখনকার মত ইউনির্ফম ছিল না । ঘন্টা বাজল, আর দশটা স্কুলেও ঘন্টা বাজে, কিন্তু ধরণীদার ঘন্টার এক আলাদা সুর লয় ছিল আশ্চয সুরের মুর্ছ্না তুলত ধরণীদা। সেই ছোট্ট খাট কাল মানুষটা, কাঁচাপাকা চুল, হাঁটু পযন্ত ধুতি, নাদুস নুদুস ধরণীদার তিলের খাজা।তিল খুঁজে পাওয়া ভার ছিল। তবুও আশ্চর্য আকর্ষণ ছিল ধরণীদার তিলের খাজায়। ধরণীর খাজার ঘরটা ছিল মডেল স্কুল যেখানে গড়ে উঠেছে ঠিক তার পূব পার্শ্বে আর ঠিক তার সম্মুখের ঘরটার এবার আমরা শতবর্ষ উদযাপনের অফিস খুলেছি, যেটা প্রাক্তন ছাত্রের মিলন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে

ঠিক তার পেছনে ব্যায়ামের জন্য বরাদ্দকৃত কিছু সরঞ্জাম। আমার শৈশব বন্ধু মোহিত দাঁর সাথে সাইকেলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করেছি। সে অন্যদের সাথে ব্যায়াম করে। ফলে হরিমোহনের ভারতশ্রী মনতোষ রায় ঠিক ওর পশ্চিমে কাল আলকাতরা মাখা দরজাটা হলো লাইব্রেরী রুম। যেখান থেকে আমরা গল্পের বই নিতাম। একদিন কিছু গল্পের বই খোয়া গেছে। লক্ষী বাবু যিনি মাঝে মাঝে পড়াতেন আসলে ক্যাম্প টিচার। তিনি বললেন “কবি কোথায়” দেখ সিরাজ কবি তখন গাছের ডালে বসে বই চুরি করে পড়ছে। আমার বড় ভাই সিরাজুল ইসলামও লিখত। ভয়ংকর বই পড়ার নেশা ছিল তার।

একাত্তরের হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধে, সে লড়েছে। পাক ঘাতকেরা তাকে হত্যা করতে পারেনি, হত্যা করেছে একটি ট্রাক দূর্ঘটনা লক্ষীবাবু আমাদের গেম টিচার যাঁর নেতৃত্বে তার হাতে গড়ে উঠেছিল হরিমোহনের দুর্ধষ ফুটবল টিম। জন্ম নিয়েছিল নজরুল ইসলাম ধুলুর মত ডাঃ মইনুলের মত তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের খ্যাত অ্যাথলেট আমাদের ক্লাসে প্রবেশ করে প্রথম বেঞ্চে উপবিষ্ট পরিপাটি পোষাক পরিচ্ছদের যে ছেলেটির চোখে পড়ে ওর নাম আব্দুল্লাহ হারুন পাশা। এখন সে দেশনেত্রী প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়ার পি,এস হিসাবে কর্মরত। দারুন মেধাবী ছাত্র। ওর বাবা বদলী হওয়ার সাথে সাথে ও ছেড়ে গেল আমাদের ৫৪-৫৫ কোন এক সময় আর দেখা নেই।

হঠাৎ একদিন আমি ঢাকা ফিরছি পাসপোর্ট করে রাবণের দেশ শ্রীলঙ্কায় যাব বলে প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়ার সাথী হিসাবে। একটু আনমনা ছিলাম ফেরিতে একটা কারের বনেটে বোধহয় একটু বেশী চাপ দিয়ে ফেলেছি। পাশ থেকে কে যেন বললেন দেখুন একটু সরে দাঁড়াবেন। চেয়ে দেখি হেলেন সেই হেলেন ১৯৫৪ এর হেলেন ১৯৭৯ তে এসও সেই শিশু শিশু মুখটি চিনতে আমার দেরি হয়নি। ও ইঞ্জিনিয়ার ও আমার জড়িয়ে ধরল বললো আয় গাড়ীতে আমার বউ আছে। পরিচয় হলো ওর বউ এর সাথে অনেক কথা কথায় জানলাম এল,জি,আর,ডি মিনিষ্ট্রিতে সম্ভবত ডেপুটি সেক্রেটারি। শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরেই ওর ঘরে গেলাম অনেক কাল পর ওরে আমি চিনতে পারব তো? ও আমাকে চিনতে পারবে তো? অনেক পরিবর্তন হওয়ার সত্ত্বেও ওর চোখ দুটো দেখেই চিনলাম পাশা ও আমাকে চিনেও চিনলো না ভাবলাম আমার ঢিলাঢালা পোশাক অথবা শৈশব তাকে নাড়া দেয় না। আচ্ছা ওর যদি রণজিতের সঙ্গে দেখা হোত? পাশারা কি করতেন? রণজিৎ আমাদের চেয়ে খুব একটা খারাপ ছাত্র ছিল না তবুও দারিদ্র্য তাকে হঠাৎ করে স্কুলের মাঝ পথ থেকেই ছিনিয়ে নিল। জনঅরণ্যে হারিয়ে গেল রণজিৎ।

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি পশু চিকিৎসালয়ের পাশে সেটেলমেন্ট অফিসে আমি কেস কারতে গেছি, পেছন থেকেই ডাক-এই মনিবিস্মৃতির অতল গহবর থেকে উঠে এল হরিমোহনের রণজিৎ। সেটেলমেন্ট অফিসের পিয়ন সে। শুনলাম জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিকের টিকে থাকার ইতিহাস অনির্বচনীয় আনন্দ মনে হলো সেই কৈশোরেই আমি ফিরে গেছি। ও জানতে চাইলো হাবিব, আনোয়ার, সিরাজ আর মান্নার (ইকবাল আজাহার খান পাকিস্তানের ক্রিকেট আম্পায়ার সমিতির সদস্য) কথা। হাবিব এখন এডিসোনাল কমিশনার, আনোয়ার কর্ণেলের লেবাস ছেড়ে তবলিগ করছে এবং সিরাজ অধ্যাপনা করছে শাহ নিয়ামতুল্লাহ কলেজে। আর ও জানতে চাইল ধুলু ভাই নজরুল এর কথা। তুখোড় খেলোয়াড়। হরিমোহনের পশ্চিমত বার পোষ্টের ঠিক পশ্চিমে মোঠো রাস্তার ওপারে কাঁচা মিষ্টি আমের গাছ, একটি বল মারলে অনেক কাঁচা আম পড়ে। ধুলু ভাই হরিমোহন ফুটবল জগতের একটি অবিস্মরণীয় নাম। রাজারামপুর হাইস্কুলের সঙ্গে ফাইনাল খেলা সেটি এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া, টিফিনেই ছুটি। সেবার তিনদিন সকাল বিকাল খেলা চলছে সুতীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতার মধ্যে জয়ের মালা পড়েছিল হরিমোহন।